২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ : একটি পর্যালোচনা

জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ : একটি পর্যালোচনা
জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ : একটি পর্যালোচনা - ছবি : সংগৃহীত

৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কথিত ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের জয়জয়কার সুখ্যাতি এবং বুদ্ধিজীবীদের চলনে-বলনে যতই মুখরোচক হচ্ছে, ততই তদন্তকারী বা গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যবহুল ভিন্ন প্রতিবেদন জাতীয় পত্রিকায় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে।

১৬ জানুয়ারি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার ও রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসের নিকৃষ্ট নির্বাচন হলো বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। আসল কথা হলো, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নির্বাচনের ফলাফল চুরি করেছে, আর যারা নিজেদের সরকার বলে দাবি করছে তারা অবৈধ বলেই ব্যাপক অভিযোগ। বাংলাদেশে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন, ভঙ্গুর গণতন্ত্র, সরকারের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারিতাসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দ্য ফ্রাইডে টাইমসের চলতি সংখ্যায় লেখা এক বিশেষ নিবন্ধে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন মাইলাম।


নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে নিবন্ধে কড়া সমালোচনা করে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন, এটা বিশ্ব শান্তি রক্ষা মিশনে বাহিনীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং প্রশ্ন তৈরি হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে ২০১১ সাল থেকে বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা ধারণা পোষণ করে আসছিলেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষে তা প্রমাণসহ দেখিয়ে দিলো। বিরোধী দলগুলোর ওপর যত রকমের সন্ত্রাস চালানো যায়, তার সবগুলো প্রয়োগ করেই ৩০ ডিসেম্বরের ভোট হয়েছে। ভোট চুরির সব নোংরা কৌশল প্রয়োগ করে শেখ হাসিনার দল ৯৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ ফলাফল নিজের জন্য বাগিয়ে নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের ভোটের চিত্র তুলে ধরে মাইলাম বলেন, বিরোধী দলের প্রার্থীরা যেন তাদের আসনগুলোতে কোনো প্রচার-প্রচারণা না চালায়, বাইরে না যায়, সেজন্য হুমকি আর ভয় দেখানো হয়েছিল।

মিথ্যা মামলায় অনেককে আটক করা হয়। অনেকের নামে আগেই আদালতে প্রহসনের মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিছু মানুষকে গুম করা হয়েছে। নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রাণশক্তি, পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। এ ভয়েই অনেকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সাহস করেননি। ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুমকি দেয়া হয়েছে ভোটারদেরও। গ্রামে মহিলা ভোটারদের ভোট না দিতে ভয় দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আর যারা ভোট দিতে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে, তাদেরকে হুমকি কিংবা পুলিশ দিয়ে বাধা দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের ভেতরে আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজন ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছে। আমার এক বন্ধু জানিয়েছে, ‘সে যে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল তার সবগুলো ভোট কাস্ট করা হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষে।’

২০-১-২০১৯ ইং তারিখে জাতীয় পত্রিকায় জাতিসঙ্ঘের বরাত দিয়ে জাতীয় মিডিয়া আরো বলেছে, ‘৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই সঠিক ছিল না বলে দাবি করেছে জাতিসঙ্ঘ। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের পক্ষে তার মুখপাত্র বলেন, অবশ্যই নির্বাচন পারফেক্ট ছিল না। তাই আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ একটি সংলাপের জন্য উৎসাহিত করছি, যাতে যতটা সম্ভব দেশের রাজনৈতিক জীবনে ইতিবাচক শৃঙ্খলা আনা যায়।’

২৩ জানুয়ারি জাতীয় পত্রিকার খবর, ‘যুক্তরাজ্যভিত্তিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেছেন, নির্বাচনের আগের রাতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছিলেন এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও ভোটারদের কাছ থেকে নির্বাচনের এমন বিবরণ শোনার পর তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, নতুন করে নির্বাচন হওয়া দরকার। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি, ৭৫ বছর বয়সী আব্দুস সালাম বলেন, এখন সব কিছু জানতে পেরেছি এবং বলতে দ্বিধা নেই, এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি।

বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি জানায়, তাদের জরিপ করা সব এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে কেবল ক্ষমতাসীন দলই সক্রিয় ছিল। কখনো কখনো স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি সূত্রের সহায়তা নেয়া হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে ভিসা ইস্যু না করায় ভোট পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। মার্কিন তহবিলে বেশ কিছু পর্যবেক্ষক মাত্র কয়েকটি নির্বাচন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন। কাজেই এতে নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ‘কয়েকজন প্রিজাইডিং অফিসার আমাকে বলেছেন, ব্যালট বাক্স ভরতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে।’

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়, তবে ভবিষ্যৎ নির্বাচন যে, কতখানি ভোট ও ভোটারবিহীন হবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। বিষয়গুলো যদি স্বাধীনতার আগের ও পরবর্তী অবস্থায় পর্যালোচনা করি, তবে প্রতীয়মান হয়, শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি জান্তার দ্বারা সাধারণ মুক্তিকামী মানুষের ওপর শারীরিক ও মানসিক যে নির্যাতন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। ব্রিটিশ থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। তখন সেøাগান উঠেছিল ‘হাতমে বিড়ি, মুহমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’ পরে এ দেশের মানুষেরা অবস্থান পরিবর্তন করে যা বলতে চেয়েছে- ‘লাখো ইনসান ভুখা হায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হায়।’

গণমানুষ যখন স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারেনি, তখনই পাকিস্তান থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। এক সময় পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবাই মুসলিম লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। দলটিকে বাদ দিয়ে এক সময় মানুষ নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেয়, পরে আওয়ামী লীগ থেকে বিভিন্ন দল সৃষ্টি হলেও ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আইন করে সংসদে সৃষ্টি করা হয় ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ সংক্ষেপে যা ‘বাকশাল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে দলটি দল-উপদলে বিভক্ত হলেও বর্তমানে আওয়ামী লীগ নামে পরিচালিত হচ্ছে। রাজনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া স্থায়ী নয়। জনগণ বিভিন্ন সময় যুগে যুগে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিকট শোষিত হয়েছে, নিষ্পেষিত হয়েছে, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রের চেহারার পরিবর্তন করে রাষ্ট্রযন্ত্র স্বৈরাচারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু শেষ অবধি জয় হয়েছে জনগণের। জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক বুকভরা আশা নিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে, কিন্তু এখন শুরু হয়েছে ভোটবিহীন ক্ষমতা দখল। এ জন্য জবাবদিহিতা থেকে সংশ্লিষ্ট কেউই বাদ যাবে না, এটাই প্রত্যাশা। (ক্রমশ)

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement